হৃদয়ের টানে ছুটে চলি আমরা......

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস : পর্ব -১

24/01/2011 14:01

https://rongmohol.info/uploads/4_3441234729456bangla.jpg
রক্ত দিয়ে মায়ের ভাষার অধিকার আদায়ের মাস ফেব্রুয়ারী । ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই বঞ্চিত ও শোষিত পূর্ব-পাকিস্তানের জনগোষ্ঠী নিজের ভাষায় কথা বলার জন্য ১৯৪৭ সাল থেকে যে সংগ্রাম শুরু করে তা বিভিন্ন চড়াই উতরাই পেরিয়ে চূড়ান্তরূপ লাভ করেছিল ১৯৫২ এর ২১ শে ফেব্রুয়ারী । তবে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীকে অপেক্ষা করতে হয়েছে আরো দীর্ঘ ৫টি বছর । ১৯৫৬ সালের ২৬ শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্তান সংবিধান উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করে । দীর্ঘ সংগ্রামের পর অর্জিত হয় মায়ের ভাষায় কথা বলার স্বাধীনতা, আর এই ভাষা আন্দোলনের সাফল্যের পথ বেয়েই রোপিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ ।

নতুন প্রজন্মের অনেকেই শুধু ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারীকেই চেনে, এর পেছনের ধারাবাহিক আন্দোলনকে জানেনা । এর পরের কথাও অনেকের অজানা । আর এই না জানার সূত্র ধরেই আজ কেউ কেউ ভাষা সৈনিক হয়ে যান যারা মূলধারার ভাষা আন্দোলনের সাথে সম্পূর্ণরূপেই বিচ্ছিন্ন ছিলেন । তাই নতুন প্রজন্মের ব্লগারদের জন্য ভাষা আন্দোলনের সত্যিকারের ইতিহাস তুলে ধরার জন্য চেষ্টা করবো ।

সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ : তমদ্দুন মজলিশ "পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে? বাংলা নাকি উর্দু ? " নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে যেখানে সর্বপ্রথম বাংলাকে পাকিস্তানের একটি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করার দাবী করা হয় । উল্লেখ্য সেই সময়ে সরকারী কাজকর্ম ছাড়াও সকল ডাকটিকেট, পোষ্টকার্ড, ট্রেন টিকেটে কেবলমাত্র উর্দু এবং ইংরেজীতে লেখা থাকতো । পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাংলা সংস্কৃতিকে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি এবং বাংলা ভাষাকে হিন্দুয়ানী ভাষা হিসাবে অভিহিত করে এবং তারা পূর্ব-পাকিস্তানের সংস্কৃতিকে "পাকিস্তানাইজ", যেটি উর্দু এবং তাদের ভাষায় ইসলামিক, করার চেষ্টা চালাতে থাকে ।

তমদ্দুন মজলিশের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক আবুল কাশেম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হওয়া উচিত সে ব্যাপারে একটি সভা আহবান করেন । সেই সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারের কাছে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ।

বাংলাদেশের অন্য সকল আন্দোলনের মত ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগারও তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় । (১, ২)
https://rongmohol.info/uploads/4_3441234729509feb02.jpg
নভেম্বর ১৯৪৭ : পাকিস্তানের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের উদ্যোগে পশ্চিম পাকিস্তানে আয়োজিত "পাকিস্তান এডুকেশনাল কনফারেন্সে" পূর্ব - পাকিস্তান হতে আগত প্রতিনিধিরা উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন এবং বাংলাকেও সম-অধিকার প্রদানের দাবী জানান ।

ডিসেম্বর ১৯৪৭ : শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের উদ্যোগের বিপক্ষে ঢাকায় তমদ্দুন মজলিশের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশ এবং মিছিল হয় । এবং ৮ ডিসেম্বর একটি সমাবেশ হতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবী উত্থাপিত হয় । ডিসেম্বরের শেষের দিকে গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এবং তমদ্দুন মজলিশের অধ্যাপক নুরুল হক ভুইয়া এর আহবায়ক নিযুক্ত হন । (৩)

জানুয়ারী ১৯৪৮ : পূর্ব পাকিস্তান স্টুডেন্টস লিগের জন্ম । এর প্রথম সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তখন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস শেখ মুজিবুর রহমান । পূর্ব পাকিস্তান ষ্টুডেন্টস লীগে ডান ও বামধারার ছাত্রনেতাদের একটি সম্মিলন হয় । উল্লেখ্য প্রতিষ্ঠাতাদের প্রায় সবাই ছিলেন মুসলিম ছাত্রনেতা । এটি গঠনের মুল লক্ষ্য ছিলো মুসলিম লীগ সরকারের এন্টি বেঙ্গলী পলিসির বিপক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তোলা । স্টুডেন্টস লীগের উদ্যোগে জানুয়ারীতে ঢাকায় ৭ দিন ব্যাপী একটি ওয়ার্কার্স ক্যাম্প করা হয় যাতে মুসলিম লীগ এর বাংলা সংস্কৃতিকে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি এবং বাংলাকে হিন্দুয়ানী ভাষা এবং সেই সুবাদে উর্দু অপেক্ষা ইনফেরিয়র প্রমাণ করার যে ধর্মের আড়ালে প্রচারণা চালানো হচ্ছিল তার বিপক্ষে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ার কৌশল আলোচিত হয় । (৪)
https://rongmohol.info/uploads/4_3441234729549feb01.gif
২৫ ফেব্রুয়ারী ১৯৪৮ : কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত বাঙ্গালী গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পার্লামেন্টে প্রথমবারের মত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করার জন্য একটি বিল আনেন । মজলুম জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীসহ, বাঙালী পার্লামেন্ট সদস্যদের একাংশ এর পক্ষে সমর্থন দিলেও মুসলিম লীগ সমর্থিত এমপিরা এর বিপক্ষে অবস্থান নেন । পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত সদস্য খাজা নাজিমুদ্দিন ছিলেন এই বিরোধিতার শীর্ষে এবং তার সক্রিয় সমর্থনে এই বিলটিকে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতিকে পাকিস্তানের সংস্কৃতিতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা আখ্যায়িত করে প্রধান মন্ত্রী লিয়াকত আলী এর তীব্র বিরোধিতা করেন এবং বিলটি বাতিল করা হয় । ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত চুপ না থেকে তিনবার বিভিন্ন সংশোধনী সহ বিলটি পুনরায় উত্থাপন করেন কিন্তু প্রতিবারই তা একই ভাগ্যবরণ করে । (৪)

৪-৭ মার্চ ১৯৪৮ : বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠাকে সামনে রেখে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতির শীর্ষমুখদের সমন্বয়ে গঠিত হয় ষ্টুডেন্টস এ্যাকশন কমিটি । এই ষ্টুডেন্টস এ্যাকশন কমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের রূপরেখা প্রণয়ন করে । ষ্টুডেন্টস এ্যাকশন কমিটির উদ্যোগে ১১ মার্চ ১৯৪৮ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয় । (২, ৪)

১১ মার্চ ১৯৪৮ : এইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার দাবীতে একটি বড় সমাবেশ আয়োজন করা হয় । সমাবেশ শেষে বের হওয়া মিছিলে মুসলিম লীগ সরকারের পেটোয়া পুলিশ বাহিনী হামলা চালায় এবং মিছিল থেকে কাজী গোলাম মাহবুব, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ সহ আরো বেশ কয়েকজন ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতার করা হয় । (২, ৫)

১৫ মার্চ ১৯৪৮ : মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর পূর্ব পাকিস্তান সফরের প্রাক্কালে বিস্ফোরন্মুখ পরিস্থিতি মোকাবেলায় খাজা নাজিমুদ্দিন ষ্টুডেন্টস একশন কমিটির সাথে একটি বৈঠকে বসেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার একটি অঙ্গীকারনামা সই করেন । পরবর্তীতে জিন্নাহ এই অঙ্গীকারনামা বাতিল করেন এবং উর্দু (যা ছিল ৫% মানুষের মাতৃভাষা) কে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন । উপেক্ষিত হয় পাকিস্তানের প্রায় ৫০% মানুষের মাতৃভাষা বাংলা । (৫)

২১ মার্চ - ১৯৪৮ : রেসকোর্স ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এর পূর্ব - পাকিস্তান সফর উপলক্ষে আয়োজিত একটি বিশাল সমাবেশে জিন্নাহ স্পষ্ট ঘোষণা করেন যে "উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা" । সমাবেশস্থলে উপস্থিত ছাত্র নেতৃবৃন্দ ও জনতার একাংশ সাথে সাথে তার প্রতিবাদ করে ওঠে । জিন্নাহ সেই প্রতিবাদকে আমলে না নিয়ে তার বক্তব্য অব্যাহত রাখেন । (৪, ৬)

২৪ মার্চ ১৯৪৮ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ "ষ্টুডেন্টস রোল ইন নেশন বিল্ডিং" শিরোণামে একটি ভাষণ প্রদান করেন । সেখানে তিনি ক্যাটেগরিক্যালী বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার দাবীকে নাকচ করে দিয়ে বলেন "পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একটি এবং সেটি উর্দু, একমাত্র উর্দুই পাকিস্তানের মুসলিম পরিচয়কে তুলে ধরে । তার মুল বক্তৃতা থেকে "The State language therefore, must obviously be Urdu, a language that has been nurtured by a hundred million Muslims of this sub-continent, a language understood throughout the length and breadth of Pakistan and above all a language which, more than any other provincial language, embodies the best that is in Islamic culture and Muslim tradition and is nearest to the language used in other Islamic countries." (৭)

জিন্নাহর এই ব্ক্তব্য সমাবর্তন স্থলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং ষ্টুডেন্টস এ্যাকশন কমিটির সদস্যরা দাড়িয়ে নো নো বলে প্রতিবাদ করেন । জিন্নাহর এই বাংলা বিরোধী স্পষ্ট অবস্থানের ফলে পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলন আরো বেশী গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে এবং আন্দোলন ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে । (৮)

২৬ মার্চ ১৯৪৮ : জিন্নাহ ছাত্র নেতৃবৃন্দের সাথে রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে বৈঠক করেন এবং বৈঠকে তিনি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে তার অনড় অবস্থানের কথা জানিয়ে দেন । সেই সাথে ১৫ই মার্চ ষ্টুডেন্টস একশন কমিটির সাথে খাজা নাজিমুদ্দিনের বাংলাকে পূর্ব-পাকিস্তানের প্রাদেশিক ভাষা হিসাবে স্বীকৃতির অঙ্গীকারনামা বাতিল ঘোষণা করেন । (৯)

২৮ মার্চ ১৯৪৮ : ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে এক রেডিও ভাষণে জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে তার মনোভাব পুনর্ব্যক্ত করেন । (১০)
https://rongmohol.info/uploads/4_3441234729574map47.jpg
১৯৪৭ সালের দ্বিজাতি তত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত তৎকালিন পাকিস্তানের মানচিত্র
চলবে . . .

তথ্যসুত্র :
১। Talukder Maniruzzaman, The Bangladesh Revolution and its Aftermath, Bangladesh Books International Ltd., Dhaka, Bangladesh, 1980
২। virtualbangladesh.com/history/ekushe.html
৩। ভাষা আন্দোলন, বাংলাপিডিয়া, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি ।
৪। Rangalal Sen, “Political Elites in Bangladesh” (Dhaka, UPL, 1986)
৫। Hasan Zaheer, The Separation of East Pakistan - The Rise and Realization of Bengali Muslim Nationalism, Oxford University Press, Karachi, Pakistan, 1994
৬। Martyr Dhirendranath Datta
My tribute to the forgotten Harbinger of the Bengali language movement
By M. Waheeduzzaman Manik
৭ । https://www.mofa.gov.pk/Pages/Qua_Speeches/
৮। ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি । বদরুদ্দিন ওমর ।
৯ । Kabir, Ghulam Muhammad (1980). Minority Politics in Bangladesh (1947-’71). (New Delhi: Vikas Publishjng House Pvt. Ltd).
১০ । en.wikipedia.org/wiki/Bengali_Language_Movement

HTML Comment Box is loading comments...

free counters
Back

Search site

পরিচালনায়- নাজমুল হাসান >>>> সম্পাদনায়-আরাফাত রহমান রানা

obj=new Object;obj.clockfile="5031-blue.swf";obj.TimeZone="GMT0600";obj.width=145;obj.height=50;obj.wmode="transparent";showClock(obj);